প্রস্তাবিত বাজেট জীবন-জীবিকা কি পুনরুদ্ধার হবে?

অর্থমন্ত্রীপ্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। এ শিরোনামের যৌক্তিকতা রয়েছে। করোনা অভিঘাতের প্রথম ধাক্কায় জনগণ এক অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে। বেকারত্ব বেড়েছে। আয় কমেছে। ফলে নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে। অভিঘাতের দ্বিতীয় ধাক্কা অনিশ্চয়তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, বৃদ্ধ, শিশু, নারীসহ সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার।
 

মানুষ প্রত্যাশা করেছে এবারের বাজেটে প্রতিটি খানায় সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছানো, সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা, কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বৃদ্ধি, রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্যকরণ, শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ধরে মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা এবং মন্ত্রীর কথা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? 

নতুন দারিদ্র্য ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিভিন্ন হিসাব বলছে, কভিডের কারণে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। উন্নয়ন অন্বেষণের হিসাব বলছে, লকডাউন পরিস্থিতি আরো বাড়তে থাকলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ শতাংশে দাঁড়াবে। মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হলেও সুবিধাভোগীদের ভাতার পরিমাণ পরিবর্তন হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ১৪ লাখ মানুষকে নতুন করে আওতায় আনা হয়েছে। উপরন্তু, বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি প্রদানে যাবে।

বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কিছু মৌলিক কৌশলগত সমস্যা রয়ে গেছে। প্রথমত, প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ না করেও অনেকে সুবিধা পাচ্ছেন। সরকারি প্রতিবেদনই বলছে, যোগ্য না হয়েও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা নেন ৪৬ শতাংশ সুবিধাভোগী। দ্বিতীয়ত, অনেকে যোগ্য হয়েও কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছেন। তৃতীয়ত, বরাদ্দকৃত অর্থ নতুন যোগ হওয়া আড়াই কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক কম। চতুর্থত, বর্তমানে প্রচলিত কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়। কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষকে লক্ষ্য করে কর্মসূচিগুলো গৃহীত। ফলে সুবিধাভোগী বাছাই করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। জনসংখ্যার তথ্যভিত্তিক ডাটাবেজ নেই। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগী বাছাই করা যাচ্ছে না এবং সরকার সবার কাছে সহায়তা পৌঁছতে পারছে না। করোনার অভিঘাতে খানাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যেকোনো অভিঘাতে খানাগুলোর ঝুঁকি হ্রাসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পূর্ণ জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন। সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয় সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা—সাতটি খাতে এ কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। এজন্য বাংলাদেশের মোট প্রয়োজন জিডিপির ২০ শতাংশ বরাদ্দ। 

জীবন বাঁচাতে ও অতিমারী মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাত 

টাকার অংকে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। গত বাজেটে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এবার তা কমে জিডিপির দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের অংশ হিসেবে বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এবার তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া জিডিপির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে বাংলাদেশ সবার চেয়ে পিছিয়ে।  স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে নেই।   

স্বাস্থ্য খাতের মাত্র ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ খরচ আসে সরকারি ব্যয় থেকে। বাকি টাকা জনগণকে পকেট থেকে দিতে হয়। ব্যক্তিগত খরচ (ওওপি) বেশি। ব্যক্তিগত খরচ কমাতে বাজেটে কোনো নির্দেশনা বা বিশেষ কর্মসূচি নেই। বাংলাদেশে ওওপি ৭৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। ভারতে এটি ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং নেপালে ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু সরকারি ব্যয় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম  ৮৮ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানে এটি ১২৯, ভারতে ২৬৯, শ্রীলংকায় ৩৬৯ এবং মালদ্বীপে ২ হাজার মার্কিন ডলার। দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাতে যা বরাদ্দ দেয়া হয়, তা-ও সম্পূর্ণ খরচ করা সম্ভব হয় না। মূলত স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত অনেক সমস্যার কারণেই বরদ্দকৃত অর্থ খরচে অদক্ষতা দেখা যায়।  রোগীর তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ডাক্তার আছেন ৫ দশমিক ২৬ জন। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ভারতে এ হার ৭ দশমিক ৭৭, পাকিস্তানে ৯ দশমিক ৭৫, শ্রীলংকায় ৯ দশমিক ৫, নেপালে ৬ দশমিক ৫, মিয়ানমারে ৮ দশমিক ৬ এবং মালদ্বীপে ২২ দশমিক ৩। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার রোগীর জন্য কমপক্ষে ২৩ জন ডাক্তার, নার্স ও মিডওয়াইফ থাকতে হবে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে নার্স আছেন মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৬ জন, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। রোগীর তুলনায় ডাক্তার অনেক কম থাকায় তাদের পক্ষে পর্যাপ্ত সময় দেয়া সম্ভব হয় না। অনেকে বাধ্য হন বেসরকারি হাসপাতালে যেতে। জনসংখ্যার ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার জন্য ফার্মেসি, হাতুড়ে ডাক্তার বা কবিরাজের কাছে যায়। মাত্র ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ সরকারি সেবা গ্রহণ করে। বেসরকারি হাসপাতালেও ডাক্তার রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। তাছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবা এবং নিবিড় পরিচর্যার খরচ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে যথাক্রমে ৮৯ ও ২৫ শতাংশ বেশি। সরকারি হাসপাতালগুলোয় একজন কভিড রোগীর পেছনে গড়ে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১১৯ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি রোগীর পেছনে খরচ হয় ২ লাখ ২২ হাজার ৭৪ টাকা। সরকারি হাসপাতালের প্রায় দ্বিগুণ। ডাক্তার সংখ্যা বাড়াতে এবং রোগী দেখার সময় বৃদ্ধি করতে বাজেটে কোনো পরিকল্পনা নেই। 

সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগ নির্ণয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। থাকলেও সেবা পাওয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। রোগীদের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের জন্য যেতে হয়। খরচ অত্যন্ত বেশি। বিভিন্ন কোম্পানি কিছু অসাধু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে রাখে বলে অভিযোগ আছে। অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত দরিদ্রদের বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ খরচ বহনের সামর্থ্য নেই। রোগ নির্ণয়ের দাম কমাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার যৎসামান্য বরাদ্দ দিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত সরঞ্জামের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয়।  তার ওপরে হাসপাতালগুলোয় বিভিন্ন সামগ্রী ও সরঞ্জাম ক্রয়ে পুকুরচুরির অভিযোগ উঠছে। কেনাকাটায় বহুগুণ বেশি মূল্য দেখানো হচ্ছে। এ রকম দুর্নীতি ও লুটপাট না হলে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে আরো বেশি সরঞ্জাম ক্রয় করা যেত। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সরবরাহ বাড়ানো যেত। অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাজেটে কোনো পথনকশা নেই। করোনা মোকাবেলায় বিশেষ তহবিল রাখা হলেও অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় আলাদা গুরুত্ব পায়নি। অথচ করোনার পাশাপাশি অসংক্রামক রোগও বাড়ছে। সুনির্দিষ্ট সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কাঠামোর পরিকল্পনা বাজেটে নেই। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেড়ে চললেও কমানোর দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত। এ বছরও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ বরাদ্দ থেকে অধিকাংশ মানুষের টিকা দেয়া সম্ভব নয়।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত সমস্যা দূরীকরণে কোনো সংস্কার কর্মসূচির দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়নি। স্বাস্থ্য প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আলাদা ভাগ করে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি। এজন্য স্বাধীন স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা দরকার। প্রতিটি নাগরিকের একটি স্বাস্থ্য কার্ড থাকা চাই। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে প্রতিটি নাগরিকের জন্য টিকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভোটার পরিচয়পত্র, জন্ম, মৃত্যু, আয়-ব্যয়সহ নাগরিকের প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্তের ডিজিটাল ব্যবস্থা হবে জনতথ্য ভাণ্ডার। এটি ব্যবহার করে যেমন স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা যেত, তেমনি অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রদানে সহায়ক হতো। এমনকি কয়েক বছর পরপর আদমশুমারিরও প্রয়োজন হতো না। এ তথ্যভাণ্ডার থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাবে। এতে কেউ বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না, আবার অনেকগুলো কাজ একই তথ্যভাণ্ডার থেকে করতে পারায় খরচ অনেক কমে যাবে।  

শিক্ষা খাত ও দক্ষতা বৃদ্ধি  

শিক্ষা খাতে টাকার অংকে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ ও জিডিপির অংশ হিসেবে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। জিডিপি ও বাজেটের অংশ হিসেবে গেল অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ২৪ ও ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। কিন্তু তা এবার নেমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ দশমিক শূন্য ৮ ও ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউনিসেফের মতে, ৩ কোটি ৬৮ লাখ শিক্ষার্থী সব অনলাইন ক্লাস ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের প্রায় অর্ধেক বছর হারাচ্ছে। এ পরিমাণ শিক্ষাজীবন অপচয়ের কারণে দীর্ঘমেয়াদে একজন শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে প্রায় ১৩ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি হবে জিডিপির প্রায় ৩৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে ১১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হবে। আর পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শিক্ষা খাতের এত বড় ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, তা নিয়ে বাজেটে কার্যকর ব্যবস্থা ও পথনির্দেশ নেই।

বাংলাদেশের শুধু ১৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলা হলেও এতদিনেও সবার কাছে অললাইন সেবা পৌঁছানো যায়নি। করোনার বাস্তবতায় সব ছাত্রছাত্রীর কাছে অনলাইন সুবিধা ও সরঞ্জাম পৌঁছানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শিক্ষা খাতে দক্ষতা বাড়াতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, বৃত্তির ব্যবস্থা করায় দেশে নারীশিক্ষায় ইতিবাচক সাফল্য অর্জন হয়েছিল। কারিগরি শিক্ষায় বৃত্তির ব্যবস্থা করলে এখানেও অনেকের আগ্রহ বাড়বে। এক বছরের স্বল্প সুদে শিক্ষানবিশ ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু বাজেটে এ ধরনের ব্যবস্থা ও দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্ররা বসে আছে। টিউশন বা অন্যান্য কাজের মাধ্যমে তারা যে আয় করত, তারও সুযোগ নেই। ছাত্ররা এখন ঋণগ্রস্ত। অনেকেই হতাশায় আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।

গোষ্ঠীতন্ত্র লাভবান

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ অতিমারীর অভিঘাত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রসারণশীল নীতি-কাঠামো নেয়া হয়েছে। রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যক্তির হাতে এবং কারবারে সরাসরি নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে কর বাড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট করহার ২৮ শতাংশ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সবাই যখন সম্প্রসারণশীল রাজস্বনীতির আশ্রয় নিচ্ছে, বাংলাদেশ এবারের বাজেটেও গতানুগতিক রক্ষণশীল ব্যবস্থা নিয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সর্বজন খাতে প্রকৃত বরাদ্দ আগের চেয়ে কমেছে। বড় সংঘবদ্ধ ব্যবসার জন্য করপোরেট করহার কমানো হলেও ছোট কারবারের জন্য তা করা হয়নি। সাধারণ মানুষেরও কর ছাড় দেয়া হয়নি।

কমেছে ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার। বাজেটে নতুন নতুন কিছু খাতের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। মূলত কৃষি ও খাদ্য, গৃহস্থালির ইলেকট্রনিকস পণ্যে ১০ বছরের জন্য এ কর অবকাশ। কিছু তথ্যপ্রযুক্তি সেবায়ও কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পরপর দুই অর্থবছর করপোরেট হার কমানো হয়েছে। এবার কমানো হলো আড়াই শতাংশ। ফলে দুই বছরে করপোরেট কর কমেছে ৫ শতাংশ। এতে ব্যবসায়ীরা ছাড় পাবেন। স্থানীয় শিল্পকেও বড় হারে ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। গৃহস্থালি নানা ধরনের পণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভ্যাট ছাড়াও আগাম কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেটে নেই সাধারণ মানুষের জন্য কোনো ছাড়।

রক্ষণশীল কায়দায় সর্বজন খাতে প্রকৃত ব্যয় কমানো এবং কিছু খাতে কর অবকাশ দিলেও জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। অথচ এ খাতগুলো বছরের পর বছর অর্থের অদক্ষ ব্যবহার, অপচয় এবং সময়মতো কাজ শেষ না করতে পারার জন্য সমালোচিত। বাজেটে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এনার্জি ও পরিবহন খাতে। গত বছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু সর্বজনের সামাজিক খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ আগের বছরের ২২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ।

জনপ্রশাসন এখনো বাজেটের সবচেয়ে বড় খাত। প্রকৃত রাজস্ব রক্ষণশীল তাত্ত্বিকতায় সরকার ছোট হওয়ার কথা। এসব খাতে ব্যয় কমানো হতো। কিন্তু তা না করে বাড়ানো হয়েছে। বাজেটের ৬০ দশমিক ৭২ শতাংশই ব্যয় হবে পরিচালন খাতে। পরিচালন ব্যয়ের এক-চতুর্থাংশের বেশি ব্যয় হবে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট পরিচালন বাজেটের ১৯ শতাংশ। পরিচালন বাজেটের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে পেনশন পরিশোধে। অর্থাৎ বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধেই যাবে পরিচালন বাজেটের ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ।

অর্থবছরের প্রথম দিকে উন্নয়ন বরাদ্দ ব্যয়ের ধীরগতি এবং শেষ দিকের হঠাৎ উল্লম্ফন প্রশ্ন উদ্রেককারী। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরকার বাজেট বাস্তবায়ন করতে পেরেছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৯ শতাংশ। প্রতি বছর সংশোধিত বাজেটের আকার ছোট হলেও বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) বরাদ্দকৃত অর্থের আকারে খুব বেশি হেরফের হয় না।

করকাঠামো ও ঋণ

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বাজেট ঘাটতি ৬ দশমিক ২ শতাংশের মতো। ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশ জোগাড় করতে হবে ঋণ করে। বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এছাড়া সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

ঋণ বাড়লেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে নগদ অর্থ যাচ্ছে সামান্যই। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত (এসএমই) ও নারীর উন্নয়নে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ব্যবসার মোট টার্নওভার ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু বাজেটে কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরাসরি নগদ সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়নি। আবার এ খাতে আগে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নের ধীর অগ্রগতির কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। অথচ এ খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত। দেশের ৮০ শতাংশ শ্রমিকই কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। গত কয়েক বছরে সিএমএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

রফতানি পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্যকরণ, অঞ্চলভিত্তিক এবং খাতভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন কর ব্যবস্থা নিলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর করা যেত। আগামীর অগ্রযাত্রা নির্মাণে বাজেটে এ ধরনের দিকনির্দেশনা অতীব প্রয়োজনীয় ছিল। নতুন বাজার খোঁজার জন্য বাজেটে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। রফতানি বাজার পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত। আমদানির জন্য পূর্ব এশিয়া ও প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি।  শিল্প ও রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করতে কোনো ধরনের পথনির্দেশ বা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্যে যাওয়া গেলে কর কাঠামো বহুমুখীকরণ করা যেত।

বাজেট ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রায়ন 

বাজেটে জনগণের অর্থের ওপর জনগণের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। অর্থ ব্যবস্থাপনায় জনগণের প্রকৃত কোনো অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। পুরো প্রক্রিয়াটিই আমলাতান্ত্রিক এবং নির্বাহী বিভাগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। প্রথমত, প্রতি বছর প্রস্তাবিত বাজেট ও সংশোধিত বাজেটের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কীভাবে ও কেন এ পার্থক্য হলো, তা জানা যায় না। বিভিন্ন খাতে কেন ব্যয় বাড়ল বা কেন বরাদ্দকৃত অর্থের পূর্ণাঙ্গ ব্যয় সম্ভব হয়নি, তার কোনো জবাবদিহিতার সুযোগ নেই। কী প্রক্রিয়ায় বাজেট সংশোধন করা হয়, তা নিয়েও নির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। উদাহরণস্বরূপ, সংশোধিত বাজেটের আকার ছোট হলেও বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) বরাদ্দকৃত অর্থের আকারে খুব বেশি হেরফের হয়নি। দ্বিতীয়ত, বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন বাজেট সম্পর্কিত সব তথ্য ও উপাত্ত প্রাপ্তিতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। সঠিক তথ্য-উপাত্ত থাকলেই সঠিক নীতি-কৌশল প্রণয়ন সম্ভব। অনেক তথ্য-উপাত্তের মধ্যেই সামঞ্জস্য নেই। অনেক পরিসংখ্যান হালনাগাদ করা হয়নি। তৃতীয়ত, সংসদের কার্যবিধি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটি কতৃক অর্থবিল যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। এমনকি রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত অর্থবিল উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। উত্থাপিত বিলে কোনো নতুন প্রস্তাবনার সুযোগ নেই। সংসদ বাজেট পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে কিন্তু পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলের বাইরে ভোট দেন না। আবার সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই বিধায় বাজেট নিয়ে সমালোচনা ও প্রশ্ন নেই বললেই চলে। ফলে বাজেট কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই পাস হয়ে যায়। বিরোধিতার এবং কার্যকর তর্ক-বিতর্ক ও পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত বিধায় বাজেটে প্রতিবারই স্বজনতোষণ, সম্পদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক কেন্দ্রীভবন প্রাধান্য পায়। চতুর্থত, বাজেট প্রক্রিয়ায় সংসদীয় পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের সুযোগ নেই। প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি এককেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃক বছর শেষে নিরীক্ষিত হিসাবের ওপর ভিত্তি করে সংসদে কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই।

বাজেটে জনগণের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। তদারকি-জবাবদিহিতা তথা অর্থব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নের অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে সাধারণ নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হলেও মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নতুন দারিদ্র্য মোকাবেলায় অপ্রতুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে টাকার অংকে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসেবে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে নেই। কাঠামোগত সংস্কারের পথনকশাও বাজেটে অনুপস্থিত। শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, বাজেটে তা নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা ও পথনির্দেশ নেই।

সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাত কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত তিমিরেই রয়ে গেছে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ ধরে রাখতে বাজেটে নতুন নতুন খাতে কর অবকাশের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে তাতে মূলত ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর, রফতানি পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্যকরণ, অঞ্চলভিত্তিক এবং খাতভিত্তিক ভিন্ন কর ব্যবস্থা নিয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা ও ব্যবস্থা অনুপস্থিত। সরকার বাজেট বরাদ্দে গতানুগতিক সংরক্ষণশীল নীতিতেই রয়ে গেছে। অথচ অভিঘাত মোকাবেলায় সারা বিশ্ব সম্প্রসারণশীল নীতির ওপরই জোর দিচ্ছে। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করাই হতো জনগণকে দেয়া সরকারের সবচেয়ে বড় উপহার।